ছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া :::
কক্সবাজারের চকরিয়ার পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করছে লাখো মানুষ। এসব পাহাড়ে কম করে হলেও ১০ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ বসতি রয়েছে। এতে চলতি বর্ষামৌসুমে ভারি বর্ষণে যেকোনো সময় ভয়াবহ পাহাড়ধস এবং ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।
ওই এলাকার বাসিন্দা কবির হোসেন জানান, এখানকার পাহাড়ের উঁচুতে এবং পাদদেশে বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করা তিন শতাধিক পরিবার চরম ঝুঁকির মধ্যেই রয়েছে। তাদেরকে সরিয়ে না নিলে যে কোনো মুহূর্তে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে।
লক্ষ্যারচর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা কাইছার বলেন, ‘পাহাড়ঘেরা বার আউলিয়া নগর গ্রামটি কাকারা ইউনিয়নেরই অংশ। তবে সেখানে লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের কয়েক শ ভোটার পরিবার-পরিজন নিয়ে পাহাড়ি জায়গায় বসতি নির্মাণ করে রয়েছে। এসব পরিবারকে অনেক আগে থেকে তাগাদা দেওয়া হয়েছে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি থেকে দূরে থাকতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! বিষয়টি ইতিমধ্যে আমি উপজেলা পরিষদের মাসিক আইন-শৃঙ্খলা ও সমন্বয় সভায় উত্থাপন করেছি। ’
কৈয়ারবিল ইউনিয়নের ইসলামনগর গ্রামের রশিদ আহমদ জানান, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক লাগোয়া ইসলামনগর নামের পুরো গ্রামটিতে পাহাড় আর পাহাড়। সংরক্ষিত বনভূমির এসব পাহাড়ে লোক সমাগম ঘটে ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হ্যারিকেন কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানার পর। এর পর থেকে এখানে পাহাড়ের উপর এবং পাদদেশে ব্যাপকসংখ্যক বসতি গড়ে ওঠে। কিন্তু যেভাবে চারদিকে ভয়াবহ পাহাড়ধস এবং প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে তা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। এখনো ঘোর বর্ষাকাল, এই সময় লাগাতার ভারি বর্ষণ শুরু হলে ইসলামনগর পাহাড়ি এলাকায়ও পাহাড়ধসের মতো বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
কৈয়ারবিল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের ইসলামনগর পাহাড়ি এলাকায় কম করে হলেও দুই হাজার বসতি রয়েছে। সেখানে চরম ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের উঁচু-নিচু টিলা এবং পাদদেশে বসবাস করছে প্রায় তিন হাজার মানুষ। ’
তিনি জানান, পাহাড়ে বসবাসে চরম ঝুঁকি থাকলেও মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় এসব মানুষ পাহাড় ছাড়তে চাচ্ছেন না। তাঁদেরকে ইতিমধ্যে অনেকবার সতর্ক করা হয়েছে। পাশাপাশি এসব বিষয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরও অবহিত করা হয়েছে।
ডুলাহাজারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. নুরুল আমিন জানান, ডুলাহাজারা ইউনিয়নের বেশিরভাগ এলাকাই পাহাড়ি। সেখানে যুগ যুগ ধরে বসবাস করছে এখানকার মানুষ। এখানে পাহাড়ধসের তেমন ভয় না থাকলেও রয়েছে বড় বড় গাছ পড়ে প্রাণহানির আশঙ্কা। এর পরেও যেসব এলাকার মানুষ চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পাহাড়ের উঁচুতে এবং পাদদেশে বসবাস করছেন তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে।
একইভাবে খুটাখালী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামও পাহাড়বেষ্টিত। সেখানেও ব্যাপক ঝুঁকির মুখে পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করছেন অন্তত ১০ হাজার মানুষ।
খুটাখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুর রহমান জানান, সম্প্রতি পার্বত্যাঞ্চলে ভয়াবহ পাহাড়ধস এবং ব্যাপকসংখ্যক প্রাণহানির ঘটনার পর স্থানীয় চৌকিদারদের মাধ্যমে খুটাখালী ইউনিয়নের পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারী লোকজনকে দফায় দফায় সতর্ক করা হয়েছে। প্রয়োজনে তাদেরকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
বরইতলী ইউনিয়নের পহরচাঁদা গ্রামের আবদু শুক্কুর জানান, বরইতলী ইউনিয়নের পহরচাঁদাসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম বড় বড় পাহাড়বেষ্টিত। পাহাড়ের ঢালু, উঁচু টিলা ও পাদদেশে ব্যাপক বসতি রয়েছে এখানে। তাছাড়া এসব গ্রামে চলছে ব্যাপকভাবে পাহাড়নিধন। এই অবস্থায় লাগাতার ভারি বর্ষণ শুরু হলে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটবে এখানে।
বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জালাল আহমদ সিকদার বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ পাহাড়ে বসবাস করেন। পাহাড়ে বসবাস যে ঝুঁকিপূর্ণ তা জানার পরও এখানকার মানুষ এসব জায়গা ছাড়তে নারাজ। প্রয়োজনে তাঁরা মরতে পারবেন, এর পরও কোনো অবস্থাতেই ঝুঁকিপূর্ণ হলেও পাহাড় ছাড়বেন না। এই অবস্থায় ঝুঁকির মধ্যে বসবাসকারী অন্তত ১০ হাজার মানুষকে পাহাড়ধস এবং প্রাণহানির বিষয়টি জানানোর মাধ্যমে সতর্ক করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রশাসনকেও এসব বিষয় অবহিত করেছি। ’
বিএমচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বিএমচর ইউনিয়নের সিংহভাগ গ্রামই বড় বড় পাহাড়ে ঘেরা। এসব পাহাড় ব্যক্তিমালিকানাধীনও। পাহাড়বেষ্টিত এসব গ্রামে কম করে হলেও বসবাস করছে ১৫ হাজার মানুষ। এর মধ্যে বড় বড় পাহাড়ের উঁচুতে অবস্থান করায় বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন হাজারো পরিবার। কিন্তু পাদদেশ থেকে উপরে উঠার মতো তেমন কোনো সুযোগ না থাকায় চলাফেরা করতে হয় চরম ঝুঁকিতে। তার ওপর ভারি বর্ষণ শুরু হলে চলাফেরা তো বন্ধ থাকে, কোনোভাবেই যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়না। এই অবস্থায় ভয়াবহ পাহাড়ধস হলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে এখানকার বাসিন্দাদের। ’
সরেজমিন উপজেলার পাহাড়বেষ্টিত বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, পাহাড়ি এসব গ্রামে চলাচলের জন্য ইট বা কার্পেটিং কোনো ধরনের সড়ক নেই। বৃষ্টি হলেও মারাত্মকভাবে পিচ্ছিল হয়ে ওঠে পাহাড়ি এসব রাস্তা। তাছাড়া উঁচু পাহাড়ে বসবাসকারী লোকজন উঠা-নামা করার সময় পড়ে গিয়ে হাত-পা ভেঙে যায়। এই অবস্থায় লাগাতার ভারি বর্ষণ শুরু হলে বন্দি থাকা ছাড়া কোনো উপায়ান্তর নেই বলে জানালেন বসবাসকারী অনেকে।
বিএমচর পাহাড়িয়া পাড়ার গৃহবধূ তসলিমা বেগম বলেন, ‘আমাদের বাড়ি-ভিটে পাহাড়ের উপরে হলেও এখানে টিউবওয়েল নেই। তাই প্রতিদিন ১০০ ফুট নিচে গিয়ে টিউবওয়েল থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করে আনতে হয়। অন্যান্য সময় তেমন সমস্যা না হলেও বর্ষামৌসুমে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে পড়ায় নিচ থেকে পানি আনতে কী যে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ’
কাকারার বারআউলিয়া নগর গ্রামের দিনমজুর জামাল উদ্দিন বলেন, ‘বিকল্প কোনো জায়গা না থাকায় ঝুঁকি হলেও পাহাড়ের উঁচু টিলাতে বসবাস করতে হচ্ছে পরিবার-পরিজন নিয়ে। ’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার হারবাং, বরইতলী, কৈয়ারবিল, লক্ষ্যারচর, কাকারা, সুরাজপুর-মানিকপুর, বমু বিলছড়ি, ফাঁসিয়াখালী, ডুলাহাজারা, খুটাখালী, বিএমচর ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পাহাড়ি এলাকায় চরম ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছেন।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক সরদার শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘চকরিয়ার বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ এবং অবৈধভাবে বসবাসকারীদের বিরুদ্ধে শিগগিরই অভিযান পরিচালনা করা হবে। ইতিপূর্বেও এখানকার অনেক এলাকায় পাহাড় নিধনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে মামলাও দেওয়া হয়েছে। যেসব এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ বসতি রয়েছে তাদের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে যৌথ অভিযান চালানো হবে। ’
তিনি আরো বলেন, ‘লাগাতার ভারি বর্ষণের সময় কাটা পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে যায়। এতে একসময় পাহাড় ধসে পড়ে। সামনে ভারি বর্ষণ হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। ’
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘উপজেলার যেসব ইউনিয়নগুলোতে পাহাড়ি এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে মানুষ বসবাস করছে তাঁদেরকে স্ব স্ব ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের মাধ্যমে সতর্ক করা হয়েছে। এর পরেও যেসব এলাকা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ তা শনাক্ত করে বসবাসকারীদের সরিয়ে নেওয়া হবে। ’
পাঠকের মতামত: